
মেহেরপুরে বিবাহ বিচ্ছেদের হার উদ্বেগজনকভাবে বেড়েছে। বর্তমানে প্রতি ৪ ঘণ্টা ১৫ মিনিটে একটি তালাক হচ্ছে এই জেলাতে। আর বিবাহবিচ্ছেদের মাধ্যমে স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কের ইতি ঘটলেও সন্তানের ক্ষেত্রে এর প্রভাব থেকে যায় দীর্ঘমেয়াদে। বাবা-মা দুজনেই সন্তানকে নিজের কাছে রাখতে চান। ফলে সন্তানের হেফাজত ও অভিভাবকত্ব নিয়ে প্রায়ই আদালতে দেখা যায় দীর্ঘ লড়াই। তবে আইন বলছে, ডিভোর্স পরবর্তী সময়ে সন্তানের দায়িত্ব নির্ধারণে ব্যক্তিগত দাবির চেয়ে সন্তানের কল্যাণকেই সর্বাগ্রে গুরুত্ব দিতে হবে।
বাংলাদেশে এ ক্ষেত্রে কার্যকর থাকে মুসলিম ব্যক্তিগত আইন (শরিয়ত) প্রয়োগ আইন ১৯৩৭, অভিভাবকত্ব ও নাবালক আইন ১৮৯০ এবং পারিবারিক আদালত অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫। সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র অ্যাডভোকেট ব্যারিস্টার সারওয়াত সিরাজ শুক্লা বলেন, সন্তানের হেফাজত (custody) ও অভিভাবকত্ব (guardianship) দুটি ভিন্ন বিষয়। হেফাজত মানে দৈনন্দিন লালনপালন আর অভিভাবকত্ব মানে সন্তানের আইনি ও আর্থিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার।
মুসলিম পারিবারিক আইন ১৯৩৭ অনুযায়ী মুসলমানদের পারিবারিক বিষয় ইসলামী শরিয়াহ অনুসারে নির্ধারিত হয়। বাংলাদেশে অধিকাংশ মুসলিম হানাফি মাযহাব অনুসরণ করেন। হানাফি ফিকহ অনুযায়ী ছেলে সন্তানের হেফাজত সাত বছর বয়স পর্যন্ত এবং মেয়ে সন্তানের হেফাজত বয়ঃসন্ধিকাল পর্যন্ত মায়ের কাছে থাকে। তবে আদালত প্রয়োজনে এই নিয়ম থেকে ব্যতিক্রম করে সন্তানের কল্যাণকে সর্বাগ্রে রেখে সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
অভিভাবকত্ব ও নাবালক আইন ১৮৯০ এর ৭ নম্বর ধারা অনুযায়ী আদালত সন্তানের জন্য অভিভাবক নিয়োগ করতে পারেন। ধারা ১৭ বলছে, হেফাজত বা অভিভাবকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রধান বিবেচ্য বিষয় সন্তানের সর্বোচ্চ কল্যাণ। তাত্ত্বিকভাবে, যদি পিতা জীবিত ও যোগ্য থাকেন তবে অভিভাবকত্ব তার কাছেই থাকে। তবে বাস্তবে আদালত অভিভাবকের নৈতিক চরিত্র, আর্থিক সামর্থ্য, শিক্ষাগত যোগ্যতা, পুনর্বিবাহ ও সন্তানের ইচ্ছাসহ নানা বিষয় পর্যালোচনা করে রায় দেন। পারিবারিক আদালত অর্ডিন্যান্স ১৯৮৫ এর মাধ্যমে এসব মামলার শুনানি আরও সহজ হয়েছে।
বাংলাদেশের আদালতে বেশ কয়েকটি নজির রয়েছে। Rahimunnessa vs Shamsunnessa (34 DLR, 1982, HCD) মামলায় বলা হয়, মায়ের আর্থিক দুর্বলতা হেফাজতের ক্ষেত্রে বাধা নয়। Md. Shafiqur Rahman vs Sufia Khatun (41 DLR, 1989, HCD) মামলায় আদালত সন্তানের কল্যাণের স্বার্থে মায়ের পক্ষে রায় দেন। Mst. Noor Jahan vs Md. Zahirul Islam (47 DLR, 1995, AD) মামলায় সন্তানের বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষা ও ধর্মীয় পরিবেশকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। Hasina Begum vs Md. Abdur Rahman (54 DLR, 2002, HCD) মামলায় সন্তানের মতামতকে গুরুত্ব দিয়ে বিচারক খাস কামরায় কথা বলে সিদ্ধান্ত নেন। আবার Arifur Rahman vs Jahanara Begum (62 DLR, 2010, HCD) মামলায় আদালত স্পষ্ট করেন যে সন্তানের কল্যাণ পিতা বা মাতার অধিকার থেকেও অগ্রগণ্য।
আইনজীবীরা বলছেন, সন্তানের দায়িত্ব নির্ধারণে আদালত বয়স, লিঙ্গ, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, ধর্মীয় মূল্যবোধ ও অভিভাবকের নৈতিক চরিত্র ও আর্থিক সক্ষমতা বিবেচনায় নেন। অনেক ক্ষেত্রেই সন্তানের মতামতকে গুরুত্ব সহকারে শোনা হয়। ফলে ডিভোর্স-পরবর্তী সময়ে সন্তানের দায়িত্ব কার হবে তা নির্ধারণে কোনো একক মানদণ্ড কার্যকর নয়; বরং আদালতের চোখে সন্তানের কল্যাণই চূড়ান্ত।