
মেহেরপুরে র্যাব-১২, সিপিসি-৩ ক্যাম্পের এফএস পদে কর্মরত কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন (বিপি নং-৯৭১৮২০৬৪৯৪) একের পর এক ভয়ঙ্কর কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
গত ১লা সেপ্টেম্বর কনস্টেবল মামুন র্যাবের এক সোর্সকে সঙ্গে নিয়ে সিভিল ড্রেসে জেলা জজ আদালতের বাইরে জামিনে থাকা এক আসামিকে ধরতে গেলে স্থানীয়রা বাধা দেয়। এসময় মামুন ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। উপস্থিত আইনজীবীরা তার পরিচয় নিশ্চিত করতে আইডি কার্ড চাইলে তিনি উত্তেজিত হয়ে এডভোকেট সেলিম রেজা কল্লোলকে রাতের মধ্যে গুম করার হুমকি দেন। এতে উত্তেজিত জনতা র্যাব সদস্যদের ওপর হামলা চালায় এবং মামুন গণধোলাইয়ের শিকার হন। পরবর্তীতে সদর থানা পুলিশ ও র্যাব কোম্পানি কমান্ডার ঘটনাস্থলে যেয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনেন।

আদালত পাড়ার এই ঘটনার পর অনুসন্ধানে মামুনের বিরুদ্ধে বেরিয়ে আসে আরও অনেক ভয়াবহ তথ্য।
আসামির স্ত্রীর সাথে পরকিয়ার অভিযোগ
গত ১১ মে গাংনী উপজেলার চিতলা ফার্ম মধ্যেপাড়া গ্রামের বাসিন্দা মো. হাসমত আলীকে ৪৮ পিস ইয়াবাসহ আটক করে র্যাব-১২। অভিযোগ উঠেছে, হাসমতের স্ত্রীকে জামিনের প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখিয়ে কনস্টেবল মামুন তার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েন। স্থানীয়রা জানান, মামুনকে ওই গৃহবধূ ও তার ছোট কন্যার সঙ্গে পার্ক, কফি শপসহ বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে দেখা গেছে। এমনকি সরকারি মোটরসাইকেলে আদালত এলাকা থেকে কফি হাউসে নিয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটেছে।
চাঁদাবাজি ও নির্যাতনের অভিযোগ
কনস্টেবল মামুনের বিরুদ্ধে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদা দাবি, শারীরিক নির্যাতন এবং চাঁদার টাকা না দিলে মিথ্যা মামলা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। ভুক্তভোগীদের দাবি, মামুন বিভিন্ন ব্যবসায়ী, গরুর খামারি ও চাকরিজীবীদের টার্গেট করে চাঁদা দাবি করতেন।
গরুর খামারি জসিম উদ্দিন জানান, গত ৮ মে মামুন তাকে ফোনে চাঁদা দাবি করেন এবং পরে বাড়িতে গিয়ে পিস্তল ঠেকিয়ে মাদক মামলায় ফাঁসানোর হুমকি দেন। পরে আবারও ফোন করে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন।
জুগিন্দা গ্রামের মিনজারুল ইসলাম অভিযোগ করেন, মামুন তার বাড়িতে গিয়ে গাঁজার ব্যবসায়ী বানানোর হুমকি দেন এবং সোর্স মোশারফের মাধ্যমে ৫০ হাজার টাকা দাবি করেন। টাকা না পেলে তাকে মারধর করে মিথ্যা গাঁজার মামলায় চালান দেন।
আরেক ভুক্তভোগী পলিয়ারা জানান, মামুন বাড়িতে এসে টাকা না পেয়ে মারধর করেন এবং স্বামীকে হুমকি দেন। স্থানীয় মনোয়ারা খাতুনও একই ধরনের অভিজ্ঞতার কথা জানান।
কাজিপুর ইউনিয়নের ব্রজপুর গ্রামের ভ্রাম্যমাণ গার্মেন্টস ব্যাবসায়ী বেল্টু মিয়ার কাছেও ৫০ হাজার টাকা চাদা দাবি করেন এই র্যাব সদস্য। তাকে চাদা না দেয়া হলে সমস্যা হতে পারে বলে হুমকি প্রদান করে।
পশুহাটে চাঁদাবাজি
অনুসন্ধানে জানা যায়, মামুন গাংনী র্যাব ক্যাম্পের সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার এএসপি কপিল দেব গাইন ও এএসপি এনামুল হকের নাম ভাঙিয়ে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। জেলার বিভিন্ন পশুহাটে গিয়ে ইজারাদারদের কাছে খাম দাবি করতেন। এক পশুহাটের ইজারাদার বলেন, মামুন এসে জানায়, “স্যারের নির্দেশে এসেছি, খাম রেডি রাখবেন।” আরেক ব্যবসায়ী জানান, মামুন তাকে হুমকি দিয়ে বলেন, “ভাইবেন না র্যাব মারা গেছে। কথা না শুনলে বিপদে পড়বেন।”
স্থানীয়দের ক্ষোভ, একজন কনস্টেবল হয়েও মামুন কিভাবে এতো প্রভাবশালী হয়ে উঠলেন এবং এখনও সাধারণ মানুষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে চাঁদাবাজি চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এসব কর্মকাণ্ডে এলাকায় তীব্র ক্ষোভ ও সমালোচনা দেখা দিয়েছে।
র্যাব–১২, সিপিসি–৩ মেহেরপুর ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার লে. বিএন ওয়াহিদুজ্জামান অভিযোগগুলোকে গুরুত্বের সাথে নিয়ে ঊর্ধ্বতন কতৃপক্ষের নির্দেশনা মোতাবেক তদন্ত করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন।
তিনি বলেন, ‘জসিম নামে একজন লিখিত অভিযোগ দিয়েছিলেন যে কনস্টেবল মামুন তাকে ফোনে চাঁদাবাজি ও হুমকি দিয়েছে। আমরা তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তদন্ত করেছি, কিন্তু এর কোনো সত্যতা পাওয়া যায়নি। পশু হাটে চাঁদাবাজির অভিযোগও ছিলো, তবে আওয়াল চেয়ারম্যান আমাকে জানিয়েছেন বিষয়টি ভুল বোঝাবুঝি ছিলো এবং মীমাংসা হয়ে গেছে। ফেনসিডিল রেখে ফাঁসানোর অভিযোগেরও কোনো প্রত্যক্ষদর্শী নেই। কেবল মৌখিক অভিযোগের ভিত্তিতে সত্যতা প্রমাণ হয় না। আদালতের বাইরে আইনজীবীর সঙ্গে যে ঘটনা ঘটে সেটিও ভুল বোঝাবুঝি ছিলো। আমি নিজে উপস্থিত থেকে মীমাংসা করেছি, উভয়পক্ষই দুঃখ প্রকাশ করেছে। আমার মতে এসব নিয়ে সংবাদ করার মতো কিছু নেই।’
র্যাবের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ যখন বাহিনীটির অতীত বিতর্ক কাটিয়ে জনআস্থা পুনরুদ্ধারে উদ্যোগী, ঠিক তখনই কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুনের এমন ঔদ্ধত্যপূর্ণ ও আগ্রাসী আচরণ পুরো বাহিনীটিকে নতুন করে বিতর্কে ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন মেহেরপুর জেলা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর, জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এবং সিনিয়র আইনজীবীরা।