ঢাকা , সোমবার, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
ব্রেকিং নিউজ :
হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের পরও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মেহেরপুরে বিএনপির গণসংযোগ ও পথসভা মেহেরপুরে সূর্য ক্লাবের উদ্বোধন উপলক্ষে অনুষ্ঠানঃ গান গাইবেন জেমস মেহেরপুরে গৃহবধূর ঝুলন্ত মরদেহ উদ্ধারঃ হত্যার অভিযোগ স্বামীর বিরুদ্ধে মেহেরপুরে র‍্যাব কনস্টেবলের বিরুদ্ধে একের পর এক ভয়াবহ অভিযোগ মেহেরপুরে জেনারেল হাসপাতালের নতুন ভবনে স্বাস্থ্যসেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন মেহেরপুরে সাপের কামড়ে শিশুর মৃত্যু রাজধানীর ওয়ারীতে ২৬ কেজি গাঁজা উদ্ধারঃ আটক ১ আদালত চত্বরে নাটকীয় ভাবে আসামি অপহরণের চেষ্টাঃ ১০ জন গ্রেপ্তার মেহেরপুরে এনসিপি’র দোয়া মাহফিল মেহেরপুরের সাবেক এসপি নাহিদ গ্রেপ্তার
বিজ্ঞপ্তি :
শীঘ্রই শুভ উদ্বোধন হতে যাচ্ছে মেহেরপুর নিউজ এর  বস্তুনিষ্ঠ তথ্যে, চারপাশের খবর" নিয়ে শীঘ্রই আসছে মেহেরপুর নিউজ অনুসন্ধানী সংবাদ
শত কোটি টাকার অপরাধ সাম্রাজ্য, ছদ্মবেশে শিক্ষকতা

মেহেরপুরে দুই শিক্ষক এখন ‘জুয়া সম্রাট’

শিক্ষাদান নয়, নিজেই জুয়া এজেন্ট হয়ে যুব সমাজকে ফেলেছেন হুমকির মুখে। শিক্ষার বদলে শিখিয়েছেন অনলাইনের মাধ্যমে জুয়া খেলা। আর এতেই নিজের এলাকার যুব সমাজ সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ জুয়া খেলে হয়েছে নিঃস্ব, অন্য দিকে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন দুই কলেজ শিক্ষক। শিক্ষকতার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে তারা চালিয়ে আসছেন অনলাইন জুয়ার কারবার। অবিশ্বাস্য এই ঘটনার দুই নায়ক মেহেরপুরের মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের প্রভাষক নুরুল ইসলাম ও জামান উদ্দিন মাস্টার। বর্তমানে মেহেরপুর জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত জুয়ার এজেন্ট হিসেবে অপরাধী তারা। কয়েক বছরের ব্যবধানে গাড়ি বাড়ি সহ কয়েক কোটি টাকার মালিক ও বনে গেছেন এই দুই শিক্ষক। এখন শিক্ষকতার আড়ালে তারা জুয়ার এজেন্ট ও নিজেদের নামে একাধিক ব্যাংক খুলে বসছেন।
কথায় আছে শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর এই মেরুদন্ডের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন শিক্ষক। এজন্যই শিক্ষাকতাকে মহান পেশা বলা হয়। তবে মেহেরপুর জেলায় এখন বেশ কয়েকজন শিক্ষকের দেখা মেলে যারা জাতির মেরুদন্ড রক্ষণাবেক্ষণে পরিবর্তে অনলাইন জুয়ার মেরুদন্ড সংহত করছেন। এদের মধ্যে অন্যতম মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ও জামান উদ্দিন। ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা ঢাকায় একসাথে একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। ২০২২ সালে মেহেরপুরে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন একসাথে। বর্তমানে তাদের একজন একটি নন এমপিও কলেজের প্রভাষক এবং অন্যজন একই প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী কাম হিসাবরক্ষক। পেশাগত পরিচয়ের আড়ালে তারা গড়ে তুলেছেন ভয়াবহ এক অপরাধ সাম্রাজ্য। অনলাইন জুয়া, প্রতারণা, অর্থপাচার ও মানবপাচারের অভিযোগে এ দুজন এখন মেহেরপুরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বিভিন্ন সময়ে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে গাফিলতির তথ্য আসে প্রতিবেদকের কাছে। অর্থের বিনিময়ে পুলিশের খাতায় নাম বাদ, শিক্ষা অফিস থেকে আসা তদন্ত কমিটিকে টাকা দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া। এছাড়াও যখন যে রাজনৈতিক দলের প্রভাব আসে তখন অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসেন এই দুই শিক্ষক।
এই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ শুধু গুজব বা অনুমান নয়। তথ্য এসেছে তদন্ত ও স্বীকারোক্তি মুলক জবানবন্দি থেকে। মুজিবনগরে বিজয় শেখ নামের এক অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টের গ্রেপ্তার পরবর্তীতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে প্রথমবারের মতো উঠে আসে তাদেরই ভিত্তিতেই ২০২২ সালে মুজিবনগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হয় একটি মামলা, যার নম্বর ১০। মামলায় তাদের দুজনকে আসামি করা হয়। পরে মামলার ফাইনাল রিপোর্টে অদৃশ্য কারণে বাদ পরে তাদের নাম। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর এই তথ্য।
নুরুল ও জামান দুজনই মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে কর্মরত
নুরুল ও জামান দুজনই মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে কর্মরত

 

মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নুরুল ইসলাম, স্থানীয়ভাবে তিনি লালন মাস্টার নামে পরিচিত। তিনি ও জামান মাস্টার যৌথ মালিকানায় একাধারে চারটি এজেন্ট ব্যাংকের মালিক ও নিয়ন্ত্রক। নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টারের হাতেই পরিচালিত হয় ড্রাগন বিকাশ, ড্রাগন নগদ ও মেলবেট নামক চ্যানেল, যেগুলো ব্যবহার করে প্রতিদিন অনলাইন জুয়ার কোটি টাকা লেনদেন হয়। খুলনা বিভাগজুড়ে সিটি ব্যাংকের এজেন্ট শাখাগুলির মধ্যে তিনি এখন অন্যতম শীর্ষ এজেন্ট ব্যাংকার ও ডিপোজিটর। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এই নুরুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন একটি দোতলা প্রাসাদসম বাড়ি, কিনেছেন কয়েক বিঘা জমি, আর বিদেশে গেছেন একাধিকবার। অভিযোগ রয়েছে,মানবপাচারের মাধ্যমেও তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে লোক পাঠানোর মতো স্পর্শকাতর ঘটনার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে উঠেছে, তবে সেই বিষয়ে তিনি মুখ খুলতে রাজি হননি।
মে,২০২৫ খুলনা বিভাগীয় সিটি ব্যাংক এজেন্টের মধ্যে শীর্ষ ডিপোজিটরের পুরস্কার পেয়েছেন নুরুল
মে,২০২৫ খুলনা বিভাগীয় সিটি ব্যাংক এজেন্টের মধ্যে শীর্ষ ডিপোজিটরের পুরস্কার পেয়েছেন নুরুল
অন্যদিকে, জামান উদ্দিন ওরফে জামান মাস্টার ঢাকার একটি গার্মেন্টসে কাজ করার পর গ্রামে ফিরে মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে চাকুরী শুরু করেন। এরপর কোমরপুর বাজারে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং পয়েন্ট চালু করলে শুরু হয় তার উত্থান। তাকে নিয়েও রয়েছে একই ধরনের অভিযোগ। তিনি লাইনবেট, ওয়ান এক্স বেট ও মেলবেট এর মতো আন্তর্জাতিক জুয়া প্ল্যাটফর্মের আঞ্চলিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তিন বছরের মধ্যে মাটির ঘর থেকে উঠে এসে দোতলা বিলাসবহুল বাড়ির মালিক হন। অল্প সময়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, জমিজমা ও একাধিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। ২০২৩ সালে এক মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি স্থানীয় কিছু সাংবাদিককে মাসোহারা দিয়ে তার নাম প্রচারমাধ্যমে আসা থেকে ঠেকিয়ে রাখেন।
শুধু আর্থিক লেনদেন নয়, রাজনীতিকেও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন এই দুই শিক্ষক। নুরুল ইসলাম মাস্টার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা আমাম হোসেন মিলুর ঘনিষ্ঠ। পরে সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিচয় তৈরি করেন।
সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিচয় তৈরি করেন
২০২৪ সালে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি বাগিয়ে নেন জেলা তাঁতী লীগের যুগ্ম আহবায়কের পদ। সেই কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ওমর খৈয়াম উষা।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মাত্র কয়েকদিন আগে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নুরুল বাগিয়ে নেন জেলা তাঁতী লীগের যুগ্ম আহবায়ক পদ
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মাত্র কয়েকদিন আগে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নুরুল বাগিয়ে নেন জেলা তাঁতী লীগের যুগ্ম আহবায়ক পদ
ব্যাংকিং লেনদেন বিশ্লেষণেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এই দুই শিক্ষকের ব্যাংক হিসাবগুলিতে প্রতিনিয়ত কোটি টাকা জমা হচ্ছে, যেগুলোর প্রকৃত উৎস সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষেরই সঠিক ধারণা নেই। জামান উদ্দিনের “জারিফ এগ্রো এন্ড সীডস” ট্রেড লাইসেন্সের বিপরিতে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ৭০১৭৭৪০০৪১১৩৩ নম্বর হিসাবে দেখা গেছে গত কয়েক মাস যাবত তার ব্যাল্যান্স ২৪ মিলিয়ন থেকে ৩০ মিলিয়ন টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। প্রতিবেদন প্রস্তুতকালে সর্বশেষ গত ২৫ জুন তারিখে তার এই একটি একাউন্টেই ব্যাল্যান্স ছিল ২৭ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার কিছু বেশি।
জারিফ এগ্রোর লাইসেন্সে পরিচালিত জামানের ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের মাদার একাউন্টের ব্যালেন্স
জারিফ এগ্রোর লাইসেন্সে পরিচালিত জামানের ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের মাদার একাউন্টের ব্যালেন্স
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ডাচ বাংলা ব্যাংক মেহেরপুর শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওদের হিসাব দেখলে মনে হবে, এরা বিশাল কোনো শিল্পপতি।‘
অনুসন্ধানে জানা যায়, জামান মাস্টারের নিজস্ব এজেন্ট সিম দিয়ে মেহেরপুর জেলায় প্রথম অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট হন মুকুল ও ওয়াসিম হালদার। একসময় মুকুল অনলাইন জুয়া পরিচালনার পাশাপাশি জুয়া খেলাতেও আসক্ত হয়ে পড়েন।  ২০২১ সালে নুরুল মাষ্টার ওরফে লালন ঢাকার একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন, যেখানে আগের থেকেই জামান চাকরি করতো। এরপর ২০২২ সালে তারা দুজনেই এলাকাতে ফিরে এসে কোমরপুর বাজারে পার্টনারে ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার ব্যবসা শুরু করেন। এর চার মাস পরই তারা যৌথ ভাবে মেহেরপুর জেলায় অনলাইন জুয়ার প্রথম এজেন্টশিপ নিয়ে আনেন মুকুলের মাধ্যমে। সে সময় নুরুল ও জামান নিজেদের ডাচবাংলা ব্যাংক থেকে মুকুলকে এজেন্ট সিম ও জুয়ার ব্যবসা পরিচালনার টাকা দেয়। এক পর্যায়ে জুয়া খেলে মুকুল টাকা নষ্ট করতে শুরু করলে জামান ও নুরুল মাষ্টার মুকুলের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া পরিচালনার জন্য আলাদা কয়েকটি চ্যানেল বের করে নেন। জামান মাস্টারের চ্যানেলের নাম জামান নগদ, জামান রকেট ও জামান উপায়। আর নুরুল ওরফে লালন মাষ্টারের চ্যানেলের নাম ড্রাগন বিকাশ, ড্রাগন নগদ, ড্রাগন রকেট এবং মেলবেট চ্যানেল। এরপর থেকে জামান ও নুরুল যৌথভাবে অনলাইন জুয়ার ব্যবসা চালাতে থাকে। এমনকি মুজিবনগরের আশেপাশে তারা ৩৫ বিঘা জমি কিনেছেনও যৌথভাবে। ২০২১ সালেও নুরুলের মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাত। অথচ মাত্র দু বছর আগেই নুরুল মাষ্টার হঠাৎ দেড় কোটি টাকা খরচ করে রাজপ্রাসাদ সম বাড়ি তৈরি করে। আর এক বছর আগে জামান মাস্টার নতুন একটি বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। এর মাঝে কালবেলায় অনলাইন জুয়া নিয়ে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হতে থাকলে বাড়ির নির্মাণ কাজ কিছুটা স্থবির হয়ে যায়।অতি সম্প্রতি খুলনা বিভাগে সিটি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা গুলোর মধ্যে  সর্বোচ্চ ডিপোজি জমা করে পুরস্কৃত হয়েছেন নুরুল মাস্টার ওরফে লালন মাস্টার। তবে এলাকায় তিনি পলাতক। অনলাইন জুয়ার পাশাপাশি নুরুল মাস্টার আদম ব্যবসার কাজেও হাত পাকিয়েছেন। এলাকায় অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে না পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে কাজের নাম করে কিছু যুবক ও তরুনদের রাশিয়াযর যুদ্ধে পাঠিয়েছিল একটি প্রতারক চক্র। এই চক্রের হোতাদের মধ্যেও নুরুল আছেন বলে এলাকায় জোর গুঞ্জন রয়েছে। মূলত মেহেরপুর জেলার কয়েকজন তরুণকে রাশিয়ায় নিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে নামিয়ে দিয়েছিলো এই চক্রটি। তারা দেশে ফিরে আসার পর থেকেই নুরুল ওরফে লালন মাষ্টার এলাকা থেকে পলাতক। তবে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ায় লোক পাঠানোর নামে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা নিয়ে এলাকা থেকে উধাও নুরুল। এলাকাবাসী জানায় যৌথভাবে এই নুরুল ও জামান মাস্টার দেড়শ কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন মেহেরপুর জেলাতেই।
অনুসন্ধানকালে আরও জানা যায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আমাম হোসেন মিলু ও সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়ে মানুষকে তার প্রভাব দেখাতেন তারা। তবে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও এই জামান নুরুল এবং মাদার মাস্টার রয়েছেন বহাল তবিয়াতে। আগে আমাম হোসেন মিলু, ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রীকে যেভাবে তারা ম্যানেজ করতেন, ঠিক একইভাবে ম্যানেজ করে চলেছেন মেহেরপুর জেলা বিএনপি’র বিবাদমান দুইটি গ্রুপের শীর্ষ নেতাদের।
ইতঃপূর্বে অভিযোগের মুখে পড়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ একবার দুজনকেই শোকজ করে, কিন্তু পরে বিষয়টি আর আগায়নি।
কলেজের রেজিস্টারে পাওয়া গেছে অনলাইন জুয়াতে সম্পৃক্ততার কারণে নুরুল ও জামানকে করা শোকজের স্মারক
কলেজের রেজিস্টারে পাওয়া গেছে অনলাইন জুয়াতে সম্পৃক্ততার কারণে নুরুল ও জামানকে ইতোপূর্বে করা শোকজের প্রমাণ
মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ওমর খৈয়াম উষা প্রতিবেদককে বলেন, ‘ইতোপূর্বে দুজনের বিপক্ষে যখন অনলাইন জুয়ায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে মামলার খবর আসে তখন কলেজের পক্ষ থেকে আমরা দুজনকেই শোকজ করেছিলাম। তারা শোকজের উত্তর দিয়েছিল। এরপর আমাদের কিছুই করার ছিল না। কলেজের কাজ শেষে বাইরে তারা কি করে সেটি আমার জানার ও দেখার বিষয় না। তবে বিদেশে পাঠানোর নাম করে অনেকের কাছ থেকে নুরুল মাস্টার টাকা নিয়েছিল। ভুক্তভোগীরা আমার কলেজে এসেও অভিযোগ দিয়েছে। আমি যতটুকু জানি কিছু জমি জায়গা বিক্রি করে নুরুল সেই টাকা পরিশোধ করেছে।‘
তবে অনলাইন জুয়ায় সম্পৃক্ত থাকার কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষের শোকজের উত্তরে নুরুল ও জামান মাস্টার কি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সে বিষয়টি অধ্যক্ষ কৌশলে এড়িয়ে যান।
অভিযুক্ত দুই শিক্ষক নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেনঃ
অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি একটি কলেজে চাকরি করি। এছাড়া আমি একটি এজেন্ট ব্যাংকের সাথে আছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে ২৩ সালে আমি হজ্বে গিয়েছিলাম। আল্লাহ আমাকে কবুল করেছেন। আপনারা হয়তো জানেন এখন আমি খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছি। সিটি ব্যাংকের একটি এজেন্ট আউটলেট ছাড়া আমার এখন আর কিছুই নাই। সহায় সম্বল জমি বাড়ি সবকিছু বিক্রি করে দিয়েছি। দোয়া করেন আমার তিনটি মেয়ে নিয়ে কোন রকমে যেন ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি।‘
তার বিরুদ্ধে মানব পাচার ও বিদেশে লোক পাঠানোর নামে টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘একটা ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। উনার উপরে বিশ্বাস করে কিভাবে যে কি করেছিলাম! এখন আমি সম্পূর্ণ সর্বশান্ত।‘ তবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে লোক পাঠানোর অভিযোগের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের অফিস সহকারি কাম হিসাব রক্ষক জামান উদ্দিন ওরফে জামান মাস্টার বলেন, ‘মেহেরপুর জেলাতে আমি প্রথম ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট পয়েন্ট নিয়ে এসেছি। আমি একটি চাকরি করি, পাশাপাশি আমার স্ত্রীও একটি চাকরি করে। কিছু জমি জায়গা কিনেছি। অল্প সমেয়র মধ্যে আমার উন্নতি দেখে কোমরপুর গ্রামের অনেকেই অনেকে হিংসায় আমার নামে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের কথা শুনে আপনি আমার বিরুদ্ধে লিখলে সেটি সঠিক হবে না। আর মুজিবনগর থানায় ১০ নাম্বার মামলায় আমার নাম এসেছিল বিজয় শেখের জবানবন্দির ভিত্তিতে। সেই বিজয় শেখকেই আমি চিনি না। পরে ফাইনাল রিপোর্ট পুলিশ আমার নাম দেয়নি। মামলার চার্জশিটে আমার নাম নেই। গ্রামের লোকজন শত্রুতা বসত আমার বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে বলতে বিষয়টাকে অনেক বড় করে ফেলেছে। এছাড়া প্রভাষক নুরুল ইসলামের সাথে চলাচল থাকার কারনেও আমার অনেক বদনাম হয়ে গেছে। একই কলেজে চাকুরী করি সেজন্যই একসাথে ওঠাবসা। কিন্তু উনি যে এরকম একটা লাইনে চলে জাবেন সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। উনার মত লোকের সাথে মেশাটা আমার জীবনের একটা বড় ভুল।‘
শিক্ষা ও প্রশাসন বিভাগ থেকেও অনেকটাই নিরুত্তর প্রতিক্রিয়া এসেছেঃ
মেহেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসার হযরত আলী মুঠো ফোনে বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে একটা ট্রেনিংয়ে আছি। আর কলেজের বিষয়গুলো আমি দেখি না। কলেজের বিষয় গুলো দেখে পরিচালক খুলনা অঞ্চল। তাই এ বিষয়ে কথা বলা আমার জন্য বেয়াদবি হয়ে যাবে।‘
জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন,’আপনি যেটা বলছেন সেটা অভিযোগ মাত্র। প্রমাণিত না। এজন্য এ বিষয়ে আমি কোন কথা বলবো না। তবে আপনি যেহেতু অভিযোগ এনেছেন, বিষয়টি আমি জেলা শিক্ষা অফিসার কে খতিয়ে দেখতে বলবো।‘
এদিকে মেহেরপুরের জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিষয়টি তাদের নজরে আছে। তদন্ত চলছে।অনলাইন জুয়াতে সম্পৃক্ত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
তবে শিক্ষকদের বিষয়টি সামনে আসাতে স্থানীয়ভাবে উদ্বেগের ভেতর দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন শিক্ষানুরাগী সমাজ। এক প্রবীণ শিক্ষক বলেন, ‘যদি শিক্ষকই জুয়ার গডফাদার হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে?’
সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, একসময় চক ও বই হাতে জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্বে থাকা এই দুই শিক্ষক, এখন অর্থের মোহে ভেসে গিয়ে হয়ে উঠেছেন মেরুদণ্ডভাঙা জাতির ঘাতক। জাতির সেই মেরুদণ্ডেই তারা ঢুকিয়ে দিয়েছেন অপরাধ, লোভ ও নৈতিক পতনের ছুরি। এই চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা না নিলে, মেহেরপুর ও আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে নেমে আসবে ভয়াবহ সামাজিক ও নৈতিক বিপর্যয়।

অনুগ্রহ করে আপনার মতামত আমাদের পাঠান

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Save Your Email and Others Information

About Author Information

হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের পরও গ্রেপ্তারি পরোয়ানা

মেহেরপুরে বিএনপির গণসংযোগ ও পথসভা

শত কোটি টাকার অপরাধ সাম্রাজ্য, ছদ্মবেশে শিক্ষকতা

মেহেরপুরে দুই শিক্ষক এখন ‘জুয়া সম্রাট’

আপলোডের সময় : ১২:৪৭ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১১ জুলাই ২০২৫
শিক্ষাদান নয়, নিজেই জুয়া এজেন্ট হয়ে যুব সমাজকে ফেলেছেন হুমকির মুখে। শিক্ষার বদলে শিখিয়েছেন অনলাইনের মাধ্যমে জুয়া খেলা। আর এতেই নিজের এলাকার যুব সমাজ সহ বিভিন্ন শ্রেণী পেশার মানুষ জুয়া খেলে হয়েছে নিঃস্ব, অন্য দিকে ফুলে ফেঁপে উঠেছেন দুই কলেজ শিক্ষক। শিক্ষকতার আড়ালে দীর্ঘদিন ধরে তারা চালিয়ে আসছেন অনলাইন জুয়ার কারবার। অবিশ্বাস্য এই ঘটনার দুই নায়ক মেহেরপুরের মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের প্রভাষক নুরুল ইসলাম ও জামান উদ্দিন মাস্টার। বর্তমানে মেহেরপুর জেলা পুলিশের তালিকাভুক্ত জুয়ার এজেন্ট হিসেবে অপরাধী তারা। কয়েক বছরের ব্যবধানে গাড়ি বাড়ি সহ কয়েক কোটি টাকার মালিক ও বনে গেছেন এই দুই শিক্ষক। এখন শিক্ষকতার আড়ালে তারা জুয়ার এজেন্ট ও নিজেদের নামে একাধিক ব্যাংক খুলে বসছেন।
কথায় আছে শিক্ষা জাতির মেরুদন্ড। আর এই মেরুদন্ডের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে নিয়োজিত থাকেন শিক্ষক। এজন্যই শিক্ষাকতাকে মহান পেশা বলা হয়। তবে মেহেরপুর জেলায় এখন বেশ কয়েকজন শিক্ষকের দেখা মেলে যারা জাতির মেরুদন্ড রক্ষণাবেক্ষণে পরিবর্তে অনলাইন জুয়ার মেরুদন্ড সংহত করছেন। এদের মধ্যে অন্যতম মেহেরপুরের মুজিবনগর উপজেলার বাসিন্দা নুরুল ইসলাম ও জামান উদ্দিন। ২০২১ সাল পর্যন্ত তারা ঢাকায় একসাথে একটি গার্মেন্টসে কাজ করতেন। ২০২২ সালে মেহেরপুরে নিজ গ্রামে ফিরে আসেন একসাথে। বর্তমানে তাদের একজন একটি নন এমপিও কলেজের প্রভাষক এবং অন্যজন একই প্রতিষ্ঠানের অফিস সহকারী কাম হিসাবরক্ষক। পেশাগত পরিচয়ের আড়ালে তারা গড়ে তুলেছেন ভয়াবহ এক অপরাধ সাম্রাজ্য। অনলাইন জুয়া, প্রতারণা, অর্থপাচার ও মানবপাচারের অভিযোগে এ দুজন এখন মেহেরপুরে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
বিভিন্ন সময়ে তাদের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্তে গাফিলতির তথ্য আসে প্রতিবেদকের কাছে। অর্থের বিনিময়ে পুলিশের খাতায় নাম বাদ, শিক্ষা অফিস থেকে আসা তদন্ত কমিটিকে টাকা দিয়ে বিষয়টি ধামাচাপা দেওয়া। এছাড়াও যখন যে রাজনৈতিক দলের প্রভাব আসে তখন অর্থের বিনিময়ে তাদেরকে নিজের আয়ত্তে নিয়ে আসেন এই দুই শিক্ষক।
এই দুই শিক্ষকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ শুধু গুজব বা অনুমান নয়। তথ্য এসেছে তদন্ত ও স্বীকারোক্তি মুলক জবানবন্দি থেকে। মুজিবনগরে বিজয় শেখ নামের এক অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্টের গ্রেপ্তার পরবর্তীতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে প্রথমবারের মতো উঠে আসে তাদেরই ভিত্তিতেই ২০২২ সালে মুজিবনগর থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের হয় একটি মামলা, যার নম্বর ১০। মামলায় তাদের দুজনকে আসামি করা হয়। পরে মামলার ফাইনাল রিপোর্টে অদৃশ্য কারণে বাদ পরে তাদের নাম। অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে ভয়ঙ্কর এই তথ্য।
নুরুল ও জামান দুজনই মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে কর্মরত
নুরুল ও জামান দুজনই মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে কর্মরত

 

মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নুরুল ইসলাম, স্থানীয়ভাবে তিনি লালন মাস্টার নামে পরিচিত। তিনি ও জামান মাস্টার যৌথ মালিকানায় একাধারে চারটি এজেন্ট ব্যাংকের মালিক ও নিয়ন্ত্রক। নুরুল ইসলাম ওরফে লালন মাস্টারের হাতেই পরিচালিত হয় ড্রাগন বিকাশ, ড্রাগন নগদ ও মেলবেট নামক চ্যানেল, যেগুলো ব্যবহার করে প্রতিদিন অনলাইন জুয়ার কোটি টাকা লেনদেন হয়। খুলনা বিভাগজুড়ে সিটি ব্যাংকের এজেন্ট শাখাগুলির মধ্যে তিনি এখন অন্যতম শীর্ষ এজেন্ট ব্যাংকার ও ডিপোজিটর। মাত্র দুই বছরের ব্যবধানে এই নুরুল ইসলাম গড়ে তুলেছেন একটি দোতলা প্রাসাদসম বাড়ি, কিনেছেন কয়েক বিঘা জমি, আর বিদেশে গেছেন একাধিকবার। অভিযোগ রয়েছে,মানবপাচারের মাধ্যমেও তিনি বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধক্ষেত্রে লোক পাঠানোর মতো স্পর্শকাতর ঘটনার অভিযোগও তার বিরুদ্ধে উঠেছে, তবে সেই বিষয়ে তিনি মুখ খুলতে রাজি হননি।
মে,২০২৫ খুলনা বিভাগীয় সিটি ব্যাংক এজেন্টের মধ্যে শীর্ষ ডিপোজিটরের পুরস্কার পেয়েছেন নুরুল
মে,২০২৫ খুলনা বিভাগীয় সিটি ব্যাংক এজেন্টের মধ্যে শীর্ষ ডিপোজিটরের পুরস্কার পেয়েছেন নুরুল
অন্যদিকে, জামান উদ্দিন ওরফে জামান মাস্টার ঢাকার একটি গার্মেন্টসে কাজ করার পর গ্রামে ফিরে মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজে চাকুরী শুরু করেন। এরপর কোমরপুর বাজারে ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং পয়েন্ট চালু করলে শুরু হয় তার উত্থান। তাকে নিয়েও রয়েছে একই ধরনের অভিযোগ। তিনি লাইনবেট, ওয়ান এক্স বেট ও মেলবেট এর মতো আন্তর্জাতিক জুয়া প্ল্যাটফর্মের আঞ্চলিক এজেন্ট হিসেবে কাজ করছেন। তিন বছরের মধ্যে মাটির ঘর থেকে উঠে এসে দোতলা বিলাসবহুল বাড়ির মালিক হন। অল্প সময়ে তিনি গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি, জমিজমা ও একাধিক ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ। ২০২৩ সালে এক মামলায় তাকে গ্রেফতার করা হলেও পরে অজ্ঞাত কারণে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অভিযোগ রয়েছে, তিনি স্থানীয় কিছু সাংবাদিককে মাসোহারা দিয়ে তার নাম প্রচারমাধ্যমে আসা থেকে ঠেকিয়ে রাখেন।
শুধু আর্থিক লেনদেন নয়, রাজনীতিকেও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করেছেন এই দুই শিক্ষক। নুরুল ইসলাম মাস্টার স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা আমাম হোসেন মিলুর ঘনিষ্ঠ। পরে সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিচয় তৈরি করেন।
সাবেক মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সঙ্গে ছবি তুলে সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিচয় তৈরি করেন
২০২৪ সালে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তিনি বাগিয়ে নেন জেলা তাঁতী লীগের যুগ্ম আহবায়কের পদ। সেই কমিটির সদস্য সচিব ছিলেন মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ওমর খৈয়াম উষা।
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মাত্র কয়েকদিন আগে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নুরুল বাগিয়ে নেন জেলা তাঁতী লীগের যুগ্ম আহবায়ক পদ
আওয়ামী লীগ সরকার পতনের মাত্র কয়েকদিন আগে মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে নুরুল বাগিয়ে নেন জেলা তাঁতী লীগের যুগ্ম আহবায়ক পদ
ব্যাংকিং লেনদেন বিশ্লেষণেও স্পষ্ট হয়ে ওঠে—এই দুই শিক্ষকের ব্যাংক হিসাবগুলিতে প্রতিনিয়ত কোটি টাকা জমা হচ্ছে, যেগুলোর প্রকৃত উৎস সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্তৃপক্ষেরই সঠিক ধারণা নেই। জামান উদ্দিনের “জারিফ এগ্রো এন্ড সীডস” ট্রেড লাইসেন্সের বিপরিতে ডাচ বাংলা ব্যাংকের ৭০১৭৭৪০০৪১১৩৩ নম্বর হিসাবে দেখা গেছে গত কয়েক মাস যাবত তার ব্যাল্যান্স ২৪ মিলিয়ন থেকে ৩০ মিলিয়ন টাকার মধ্যে ওঠানামা করে। প্রতিবেদন প্রস্তুতকালে সর্বশেষ গত ২৫ জুন তারিখে তার এই একটি একাউন্টেই ব্যাল্যান্স ছিল ২৭ মিলিয়ন অর্থাৎ ২ কোটি ৭০ লাখ টাকার কিছু বেশি।
জারিফ এগ্রোর লাইসেন্সে পরিচালিত জামানের ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের মাদার একাউন্টের ব্যালেন্স
জারিফ এগ্রোর লাইসেন্সে পরিচালিত জামানের ডাচ বাংলা এজেন্ট ব্যাংকের মাদার একাউন্টের ব্যালেন্স
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন ডাচ বাংলা ব্যাংক মেহেরপুর শাখার এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ওদের হিসাব দেখলে মনে হবে, এরা বিশাল কোনো শিল্পপতি।‘
অনুসন্ধানে জানা যায়, জামান মাস্টারের নিজস্ব এজেন্ট সিম দিয়ে মেহেরপুর জেলায় প্রথম অনলাইন ক্যাসিনো এজেন্ট হন মুকুল ও ওয়াসিম হালদার। একসময় মুকুল অনলাইন জুয়া পরিচালনার পাশাপাশি জুয়া খেলাতেও আসক্ত হয়ে পড়েন।  ২০২১ সালে নুরুল মাষ্টার ওরফে লালন ঢাকার একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেন, যেখানে আগের থেকেই জামান চাকরি করতো। এরপর ২০২২ সালে তারা দুজনেই এলাকাতে ফিরে এসে কোমরপুর বাজারে পার্টনারে ডাচ বাংলা ব্যাংকের একটি এজেন্ট ব্যাংকিং শাখার ব্যবসা শুরু করেন। এর চার মাস পরই তারা যৌথ ভাবে মেহেরপুর জেলায় অনলাইন জুয়ার প্রথম এজেন্টশিপ নিয়ে আনেন মুকুলের মাধ্যমে। সে সময় নুরুল ও জামান নিজেদের ডাচবাংলা ব্যাংক থেকে মুকুলকে এজেন্ট সিম ও জুয়ার ব্যবসা পরিচালনার টাকা দেয়। এক পর্যায়ে জুয়া খেলে মুকুল টাকা নষ্ট করতে শুরু করলে জামান ও নুরুল মাষ্টার মুকুলের মাধ্যমে অনলাইন জুয়া পরিচালনার জন্য আলাদা কয়েকটি চ্যানেল বের করে নেন। জামান মাস্টারের চ্যানেলের নাম জামান নগদ, জামান রকেট ও জামান উপায়। আর নুরুল ওরফে লালন মাষ্টারের চ্যানেলের নাম ড্রাগন বিকাশ, ড্রাগন নগদ, ড্রাগন রকেট এবং মেলবেট চ্যানেল। এরপর থেকে জামান ও নুরুল যৌথভাবে অনলাইন জুয়ার ব্যবসা চালাতে থাকে। এমনকি মুজিবনগরের আশেপাশে তারা ৩৫ বিঘা জমি কিনেছেনও যৌথভাবে। ২০২১ সালেও নুরুলের মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাত। অথচ মাত্র দু বছর আগেই নুরুল মাষ্টার হঠাৎ দেড় কোটি টাকা খরচ করে রাজপ্রাসাদ সম বাড়ি তৈরি করে। আর এক বছর আগে জামান মাস্টার নতুন একটি বাড়ি তৈরির কাজ শুরু করে। এর মাঝে কালবেলায় অনলাইন জুয়া নিয়ে নিয়মিত খবর প্রকাশিত হতে থাকলে বাড়ির নির্মাণ কাজ কিছুটা স্থবির হয়ে যায়।অতি সম্প্রতি খুলনা বিভাগে সিটি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং শাখা গুলোর মধ্যে  সর্বোচ্চ ডিপোজি জমা করে পুরস্কৃত হয়েছেন নুরুল মাস্টার ওরফে লালন মাস্টার। তবে এলাকায় তিনি পলাতক। অনলাইন জুয়ার পাশাপাশি নুরুল মাস্টার আদম ব্যবসার কাজেও হাত পাকিয়েছেন। এলাকায় অনেক মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বিদেশে না পাঠানোর অভিযোগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এমনকি সম্প্রতি বাংলাদেশ থেকে কাজের নাম করে কিছু যুবক ও তরুনদের রাশিয়াযর যুদ্ধে পাঠিয়েছিল একটি প্রতারক চক্র। এই চক্রের হোতাদের মধ্যেও নুরুল আছেন বলে এলাকায় জোর গুঞ্জন রয়েছে। মূলত মেহেরপুর জেলার কয়েকজন তরুণকে রাশিয়ায় নিয়ে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামিয়ে নামিয়ে দিয়েছিলো এই চক্রটি। তারা দেশে ফিরে আসার পর থেকেই নুরুল ওরফে লালন মাষ্টার এলাকা থেকে পলাতক। তবে এলাকাবাসীর কাছ থেকে জানা গেছে অস্ট্রেলিয়া ও রাশিয়ায় লোক পাঠানোর নামে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে জনপ্রতি ২০ থেকে ৩০ লক্ষ টাকা নিয়ে এলাকা থেকে উধাও নুরুল। এলাকাবাসী জানায় যৌথভাবে এই নুরুল ও জামান মাস্টার দেড়শ কোটি টাকার সম্পদ কিনেছেন মেহেরপুর জেলাতেই।
অনুসন্ধানকালে আরও জানা যায়, স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা আমাম হোসেন মিলু ও সাবেক জনপ্রশাসন মন্ত্রী ফরহাদ হোসেনের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক দেখিয়ে মানুষকে তার প্রভাব দেখাতেন তারা। তবে ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে ক্ষমতার পট পরিবর্তন হলেও এই জামান নুরুল এবং মাদার মাস্টার রয়েছেন বহাল তবিয়াতে। আগে আমাম হোসেন মিলু, ফরহাদ হোসেন ও তার স্ত্রীকে যেভাবে তারা ম্যানেজ করতেন, ঠিক একইভাবে ম্যানেজ করে চলেছেন মেহেরপুর জেলা বিএনপি’র বিবাদমান দুইটি গ্রুপের শীর্ষ নেতাদের।
ইতঃপূর্বে অভিযোগের মুখে পড়ে কলেজ কর্তৃপক্ষ একবার দুজনকেই শোকজ করে, কিন্তু পরে বিষয়টি আর আগায়নি।
কলেজের রেজিস্টারে পাওয়া গেছে অনলাইন জুয়াতে সম্পৃক্ততার কারণে নুরুল ও জামানকে করা শোকজের স্মারক
কলেজের রেজিস্টারে পাওয়া গেছে অনলাইন জুয়াতে সম্পৃক্ততার কারণে নুরুল ও জামানকে ইতোপূর্বে করা শোকজের প্রমাণ
মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ ওমর খৈয়াম উষা প্রতিবেদককে বলেন, ‘ইতোপূর্বে দুজনের বিপক্ষে যখন অনলাইন জুয়ায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে মামলার খবর আসে তখন কলেজের পক্ষ থেকে আমরা দুজনকেই শোকজ করেছিলাম। তারা শোকজের উত্তর দিয়েছিল। এরপর আমাদের কিছুই করার ছিল না। কলেজের কাজ শেষে বাইরে তারা কি করে সেটি আমার জানার ও দেখার বিষয় না। তবে বিদেশে পাঠানোর নাম করে অনেকের কাছ থেকে নুরুল মাস্টার টাকা নিয়েছিল। ভুক্তভোগীরা আমার কলেজে এসেও অভিযোগ দিয়েছে। আমি যতটুকু জানি কিছু জমি জায়গা বিক্রি করে নুরুল সেই টাকা পরিশোধ করেছে।‘
তবে অনলাইন জুয়ায় সম্পৃক্ত থাকার কারণে কলেজ কর্তৃপক্ষের শোকজের উত্তরে নুরুল ও জামান মাস্টার কি ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন সে বিষয়টি অধ্যক্ষ কৌশলে এড়িয়ে যান।
অভিযুক্ত দুই শিক্ষক নিজেদের নির্দোষ দাবি করেছেনঃ
অনলাইন জুয়ার এজেন্ট মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের প্রভাষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ ভিত্তিহীন। আমি একটি কলেজে চাকরি করি। এছাড়া আমি একটি এজেন্ট ব্যাংকের সাথে আছি। আল্লাহর অশেষ রহমতে ২৩ সালে আমি হজ্বে গিয়েছিলাম। আল্লাহ আমাকে কবুল করেছেন। আপনারা হয়তো জানেন এখন আমি খুবই মানবেতর জীবন যাপন করছি। সিটি ব্যাংকের একটি এজেন্ট আউটলেট ছাড়া আমার এখন আর কিছুই নাই। সহায় সম্বল জমি বাড়ি সবকিছু বিক্রি করে দিয়েছি। দোয়া করেন আমার তিনটি মেয়ে নিয়ে কোন রকমে যেন ডাল ভাত খেয়ে বেঁচে থাকতে পারি।‘
তার বিরুদ্ধে মানব পাচার ও বিদেশে লোক পাঠানোর নামে টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নুরুল ইসলাম আরো বলেন, ‘একটা ভাইয়ের সাথে পরিচয় হয়েছিল। উনার উপরে বিশ্বাস করে কিভাবে যে কি করেছিলাম! এখন আমি সম্পূর্ণ সর্বশান্ত।‘ তবে রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধ ক্ষেত্রে লোক পাঠানোর অভিযোগের বিষয়টি তিনি এড়িয়ে যান।
মুজিবনগর আদর্শ মহিলা কলেজের অফিস সহকারি কাম হিসাব রক্ষক জামান উদ্দিন ওরফে জামান মাস্টার বলেন, ‘মেহেরপুর জেলাতে আমি প্রথম ডাচ বাংলা ব্যাংকের এজেন্ট পয়েন্ট নিয়ে এসেছি। আমি একটি চাকরি করি, পাশাপাশি আমার স্ত্রীও একটি চাকরি করে। কিছু জমি জায়গা কিনেছি। অল্প সমেয়র মধ্যে আমার উন্নতি দেখে কোমরপুর গ্রামের অনেকেই অনেকে হিংসায় আমার নামে এসব অপপ্রচার চালাচ্ছে। তাদের কথা শুনে আপনি আমার বিরুদ্ধে লিখলে সেটি সঠিক হবে না। আর মুজিবনগর থানায় ১০ নাম্বার মামলায় আমার নাম এসেছিল বিজয় শেখের জবানবন্দির ভিত্তিতে। সেই বিজয় শেখকেই আমি চিনি না। পরে ফাইনাল রিপোর্ট পুলিশ আমার নাম দেয়নি। মামলার চার্জশিটে আমার নাম নেই। গ্রামের লোকজন শত্রুতা বসত আমার বিরুদ্ধে নানা কথা বলতে বলতে বিষয়টাকে অনেক বড় করে ফেলেছে। এছাড়া প্রভাষক নুরুল ইসলামের সাথে চলাচল থাকার কারনেও আমার অনেক বদনাম হয়ে গেছে। একই কলেজে চাকুরী করি সেজন্যই একসাথে ওঠাবসা। কিন্তু উনি যে এরকম একটা লাইনে চলে জাবেন সেটা আমি ভাবতেও পারিনি। উনার মত লোকের সাথে মেশাটা আমার জীবনের একটা বড় ভুল।‘
শিক্ষা ও প্রশাসন বিভাগ থেকেও অনেকটাই নিরুত্তর প্রতিক্রিয়া এসেছেঃ
মেহেরপুর জেলা শিক্ষা অফিসার হযরত আলী মুঠো ফোনে বলেন, ‘আমি এই মুহূর্তে একটা ট্রেনিংয়ে আছি। আর কলেজের বিষয়গুলো আমি দেখি না। কলেজের বিষয় গুলো দেখে পরিচালক খুলনা অঞ্চল। তাই এ বিষয়ে কথা বলা আমার জন্য বেয়াদবি হয়ে যাবে।‘
জেলা প্রশাসক সিফাত মেহনাজ বিষয়টি নিয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য দিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন,’আপনি যেটা বলছেন সেটা অভিযোগ মাত্র। প্রমাণিত না। এজন্য এ বিষয়ে আমি কোন কথা বলবো না। তবে আপনি যেহেতু অভিযোগ এনেছেন, বিষয়টি আমি জেলা শিক্ষা অফিসার কে খতিয়ে দেখতে বলবো।‘
এদিকে মেহেরপুরের জেলা পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বিষয়টি তাদের নজরে আছে। তদন্ত চলছে।অনলাইন জুয়াতে সম্পৃক্ত কাউকেই ছাড় দেওয়া হবে না।
তবে শিক্ষকদের বিষয়টি সামনে আসাতে স্থানীয়ভাবে উদ্বেগের ভেতর দিয়ে সময় কাটাচ্ছেন শিক্ষানুরাগী সমাজ। এক প্রবীণ শিক্ষক বলেন, ‘যদি শিক্ষকই জুয়ার গডফাদার হয়, তাহলে শিক্ষার্থীরা কি শিখবে?’
সচেতন নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, একসময় চক ও বই হাতে জাতির ভবিষ্যৎ গড়ার দায়িত্বে থাকা এই দুই শিক্ষক, এখন অর্থের মোহে ভেসে গিয়ে হয়ে উঠেছেন মেরুদণ্ডভাঙা জাতির ঘাতক। জাতির সেই মেরুদণ্ডেই তারা ঢুকিয়ে দিয়েছেন অপরাধ, লোভ ও নৈতিক পতনের ছুরি। এই চক্রের বিরুদ্ধে দ্রুত আইনি ব্যবস্থা না নিলে, মেহেরপুর ও আশেপাশের অঞ্চলগুলোতে নেমে আসবে ভয়াবহ সামাজিক ও নৈতিক বিপর্যয়।